ছিমছাম মফস্বল এলাকা। ছোট্ট একটা গাছগাছালি ভরা পার্ক আছে এখানে। ঠিক মাঝখানটায় একটা পুকুর। পুকুরের পাশ ঘিরে ফুলের বাগান, আর বাগানের মাঝ দিয়ে পাশাপাশি হাঁটার মত দুটো রাস্তা।
শিউলি প্রতিদিন বিকেল পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত এই রাস্তা ধরে হাঁটে। একসময় অতিরিক্ত মেদ ঝেড়ে ফেলবার জন্য হাঁটত। এখন অবশ্য মেদ কমে গেছে, তবুও হাঁটা বন্ধ হয়নি। কারণটা এক্ষেত্রে একটু ভিন্ন।
মারুফ প্রতিদিন পার্কের পশ্চিম কোণার একটা বেঞ্চে বসে বাদাম খায়। এই জায়গাটা থেকে পুকুর এবং তার আশেপাশের বিশাল এলাকা স্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। প্রতিদিন বিকেল পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত তার এই বাদাম খাওয়া চলতে থাকে। বাদাম খাবার পেছনে মারুফকে প্রতিদিন হাতখরচ থেকে বিশটাকা আলাদা করে রাখতে হয়।
পার্কে আসার সময় শিউলি ভাবে যেভাবেই হোক আজ ঐ বাদাম খাওয়া ছেলেটার সাথে কথা বলবেই। মারুফের ভাবনাও একই। প্রতি দুপুরেই সে ভাবে হেলতে দুলতে কোমরে কায়দা করে ওড়না পেঁচানো মেয়েটার সাথে কথা বলবেই। কিন্তু কেউই উদ্দেশ্যে সফল হয় না।
আজ সকাল থেকেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। থামবার কোনও নিশানা নেই। বিকেল পাঁচটায় মারুফ ভিজে চুপচুপ হয়ে বেঞ্চে বসে পড়ল। পার্ক পুরো খালি। শুধু গুটিকয়েক ছেলেপেলে পালা করে পুকুরে ঝাঁপাচ্ছে। আজ কোনো বাদামওয়ালাও নেই বলে মারুফের বিশটাকা বেঁচে যাবে। ঘড়ির কাটা টিকটিক করে ছয়টা বেজে গেলেও শিউলির কোনো খবর দেখা যাচ্ছে না। সে নিশ্চিত আজ শিউলি আসবে না। তারপরও বাড়ি ফিরতে খানিক দ্বিধাবোধ করছে। কেন করছে তা অজানা।
রাতে বাড়ি ফেরেনি মারুফ। সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে বসে ছিল বেঞ্চটায়। ভেবেছিল, রাতে বোধহয় শিউলি ছাতা নিয়ে আসবে, হাত ধরে বাড়ি যেতে বলবে। কিন্তু এরকমটা বাস্তবে হয় না। মারুফ বাড়িতে ফেরে পরদিন সকালে। বৃষ্টি ততক্ষণে থেমে গেছে। হালকা শরতের মেঘ আর মিষ্টি রোদ একটি ঝলমলে দিনের আভাস দিচ্ছে।
বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ চাদর মুড়ে মারুফ আবার সেই বেঞ্চে উপস্থিত। আর আধঘন্টা পরেই চলে আসবে শিউলি। প্রচন্ড জ্বর নিয়ে বাদাম চিবুতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু বাদামওয়ালার নিরাশ মুখ যেন দেখতে না হয় সেজন্য ঠিকই বিশ টাকার বাদাম কিনল। ঘড়ির কাঁটা তখন পাঁচটা পঞ্চান্নতে ঠেকেছে। মারুফ জ্বরের ঘোরে গুনতে থাকে। তিনশ. . . দুইশ নিরানব্বই. . . দুইশ আটানব্বই. . .
না। শিউলি সেদিনও আসেনি। মারুফ বুঝতে পেরে গেছে শিউলি আর কোনোদিনও আসবে না। কিন্তু তবুও নিরাশ হয়না সে। প্রতিদিন বেঞ্চটায় বসে বাদাম হাতে অপেক্ষা করতে থাকে। পথভ্রষ্ট হয়ে কোনো একদিন তো চলে আসতেও পারে শিউলি।
শ্বশুড়বাড়ি এসে সারাদিন ঘরের কোণে পড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে শিউলি। আকাশের এক কান্নাভেজা দিনটি যে তার আজীবন কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেদিন বৃষ্টি না হলে ঠিক চলে যেত সেই বাদামখোরের কাছে। হাত ধরে প্রশ্ন করত, এত বাদাম খাও, পেট খারাপ হয় না? প্রকৃতি তাকে সেই সুযোগ দেয়নি। প্রতিমাসেই একটা না একটা সম্বন্ধ আসতে শিউলির পরিবারে। এবার শিউলির কোনো ছলচাতুরিই পারেনি ছেলেপক্ষকে বিমুখ করতে। শিউলি জানে, ছেলেটা প্রবল অভিমান করে প্রতিটি বিকেল পার করে দেয়। শিউলির প্রায়ই ইচ্ছে হয়, নিয়মের বাঁধা অতিক্রম করে ছেলেটার বিকেলের ভাগ নিতে। কিন্তু চাইলেই সবকিছু করে ফেলা যায় না। সিঁদুরের বাঁধন এখানে মনের মায়ার চেয়ে বেশি শক্তিশালী।