শুক্রবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৪

বোধ

ছোটবেলায় প্রতি শুক্রবারে বিটিভিতে সিনেমা দেখতাম। আলমগীর আর শাবানার বিয়ে হত সেই সিনেমায়। এরপর আসত বাসর রাত। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিত আলমগীর। আলতো করে ঘোমটার আড়াল থেকে খাটে হাটু ভেঙে বসে থাকা শাবানার সেই লাজুক মুখটা বের করে আনত। একটু একটু করে একে অপরের দিকে ঝুঁকে পড়তেই ক্যামেরা রোল করে ছাদে চলে যেত। বাসর রাত শেষ! একটু বড় হলে এরকম দৃশ্য দেখার পর একটা প্রশ্নই মাথায় ঘুরত। ক্যামেরার ফোকাস ছাদে চলে গেলে ওরা দুজন কি করে? বাবাকে কোন আক্কেলে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার আক্কেল দাঁতের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ছেড়েছিলেন। আরেকটু বড় হতেই বন্ধু মিলুর কাছে পেলাম আমার এই প্রশ্নের উত্তর। অদ্ভুত একটা মাদকতা ছিল মিলুর কথায়। এরপর তো ইতিহাস!

সকালবেলা দেখলাম বাবা ফুল কিনে আনলেন? কারণটা জিজ্ঞেস করে আরেকবার আমার আক্কেলদাঁতকে হুমকির সম্মুখীন করে ফেলেছিলাম। বাসর ঘরের মূল সাজই তো হল ফুল। ওহ! বলতে ভূলে গেছি, আজ আমার বাসর রাত। মানে বিয়ে। অজানা অচেনা এক মেয়ের সাথে আজ থেকে বাকিটা জীবন কাটাতে হবে। মা বলতেন আমার মত জঞ্জালের কপালে ঘরে বৌ টিকবে না। শুনলাম গতকালের হলুদে উনি নাকি বৌকে হাজারটাকা ঘুষ দিয়ে এসেছেন। অর্থাৎ আমাদের বিবাহবার্ষিকী যদি পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করে তাহলে উৎকোচ হিসেবে প্রতি বছরে বিশটাকা করে পড়ে। আধালিটার দুধের দাম সম্ভবত পঁচিশ টাকা এবং তা একজনের দুইবেলা অথবা দুইজনের একবেলা খুব ভালোমত চলে যায়।

মেয়েটার নাম নিশি। নামের সাথে কোনো মিল নেই তার। না রাতের মত কালো, না অন্ধকারের মত নিষ্প্রান। বরং হলুদাভ দুধেল গায়ের রং, এবং চটপটে দুরন্ত এক মেয়ে। বিয়ের আগে ফার্স্ট ডেটে বকবক করতে করতে আমার কান ধরিয়ে দিয়েছিল। মেয়েটা কথা বলার মাঝে মাঝে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটের বাম পাশ কামড়ে ধরে। আমি মিথ্যে বলছি না, আমি ঐ কামড়ের প্রেমে পড়ে গেছি।

বরযাত্রী যথাসময়ে বিয়েবাড়ি পৌছে গেল। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় কবুল বলে কাজী সাহেবকে ভড়কে দিল মেয়েটা। শ্বশুড়বাড়ি যাবার তাড়া একটু বেশিই বোধহয়। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝলকানিতে আমার যখন চোখের কর্নিয়া ছাই হবার অবস্থা, নিশি তখন অবলীলায় "দন্তবিকশিত" হাসিতে প্রতিটি ফ্রেমে নিজেকে আবদ্ধ করছে। আমি ওর দিকে তাকাতেও পারছি না। কোনও একটা ফ্রেমে যদি আটকে যায় আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি, খোটায় খোটায় জীবন বরবাদ হয়ে যাবে। বাড়ির পথে রওনা হব, এবার নিশির মুখ খানিকটা মলিন দেখতে পেলাম। কান্না চেপে রাখার প্রয়াস আমার চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্য হয়ে ধরা দিল।

আমি বাড়ি ফিরে আগ্রহের সাথে বাসর রাতের অপেক্ষা করছিলাম। আর কোনোকিছুই আজ পর্যন্ত এতটা আমাকে টানেনি। প্রথম প্রেমিকার প্রথম চুম্বনের কথাটা বাদ দিলে এই প্রথম আমি যেন খেই হারিয়ে ফেলছি। বন্ধুবান্ধবের পরামর্শ এবং উপদেশ সাথে নিয়ে প্রবেশ করলাম বাসর ঘরে। ফুলশয্যায় বসে আছে নিশি, ঠিক যেন শাবানা। নিজেকে আমি আজ আলমগীর ভাবতেই পারি।

কিন্তু ভাবিনি আমার আলমগীর হবার স্বপ্নটাকে স্বপ্নই রাখতে বাধ্য করবে এই নিশি। খুব ভালো করে খাটের তলা, বারান্দা, বাথরুম চেক করে যেই নিশির পাশে বসলাম, আচমকা প্রশ্ন করে বসল, "তোমার কি ঘুমের ঘোরে লাথি মারার অভ্যাস আছে।"
প্রথম দেখায় মেয়েটা আপনি করে বলেছিল। স্ত্রী হিসেবে তুমি করে বলার অধিকারটাও সে অবশ্যই রাখে। তবে এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে এটা আসলেই আমার মাথায় ছিল না। আলতো মাথা নাড়লাম।
"গুড। আমার এই অভ্যাস আছে। লাথি খেয়ে হজম করে নিও। সকালে প্রয়োজনে মালিশ করে দেব।"
কথা শেষ হতেই শুয়ে পড়ল এবং ঘুমিয়েও গেল। উঁকি দিয়ে দেখলাম, গাড় ঘুমে তলিয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ঘুমিয়ে পড়ার দক্ষতা দেখে আমি আবার প্রেমে পড়লাম। ঘুমের ঘোরে লাথি কতটা সুখকর তা আপাতত বলতে পারছি না, তবে দীর্ঘশ্বাস নেবার দৃশ্যটা নিঃসন্দেহে অভিভূত করে ফেলবার মত যথেষ্ট শক্তিশালী।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই শরীরের বিভিন্ন জায়গা টিপে দেখতে লাগলাম। ঘুমের ঘোরে লাথি দিলে বা খেলে কোনটাই টের পাওয়া যায় না। শরীর অক্ষত পেয়ে খানিকটা আশহতই হলাম মনে হয়। পাশে নিশিকে দেখতে না পেয়ে ভাবলাম চা আনতে গেছে বোধহয়। যাক! একটা দিক দিয়ে আলমগীর হতে পারি। কিন্তু আমার ধারণা ভূপাতিত করে ওকে ওঘর থেকে এসে আবার বিছানায় শুয়ে পড়তে দেখলাম। ঠোঁটের নিচে একফোঁটা জল লেগে আছে। আঙুল দিয়ে মুছে দিলাম। ভেবে আনন্দ লাগছে মা এবার আমাকে অলস বলার আগে কয়েকবার ভাববে।

দুপুরে খাবার টেবিলে বাবা বললেন নিশিকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসতে। কোথায় যাব ঠিক করার সুযোগ না দিয়েই নিশি কক্সবাজার যাবার প্রস্তাব উত্থাপন করল। অস্ফুটিত একটি হাসি বাবার সম্মতির চিহ্ন ধরে নিলাম। সেই হাসি এটাও প্রকাশ করে দিয়েছে, এই মেয়ে ইতোমধ্যেই বাবাকে বশ করে ফেলেছে।

দুদিন পরই রওনা হয়ে গেলাম কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। রেলভ্রমনের মধ্যে একটা প্রেমময় ভাব আছে। ফিঙ্গার ক্রসড, আজ বুঝি তার বোধন হবে। স্টেশনে গিয়েই দেখি প্লাটফর্মে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। নিজেদের কেবিন খুঁজে বসে পড়লাম। পাঁচদিনের দীর্ঘ সফর অথবা হানিমুনে যাচ্ছি আমরা। নিশির চোখেমুখে উত্তেজনার ছাপ। এই প্রথম বোধহয় কোনো ট্রেন যথাসময়ে ছাড়ল। আমি নিশ্চিত মাঝপথে এই ট্রেন থেমে যাবে তিন চার ঘন্টার জন্য। অন্তত ইতিহাস সেরকমটাই বলে।

"বিয়ের পর কেউ প্রেমে পড়ে না", উক্তিটি যার মস্তিষ্ক নিঃসৃত তার প্রতি এই মুহুর্তে বেশ করুণা হচ্ছে। আমি তো হরদম প্রেমে পড়ছি। এই যে, নিশি আমার কোলে মাথা রেখে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। একটিবার অনুমতিও নেয়নি। এরকম প্রেমে পড়ার কোনো বিষয়ে অনুমতি না নেয়টাই উত্তম। তবে একটা প্রশ্ন বেশ ভাবাচ্ছে আমাকে। আমি ওকে কিভাবে নিয়েছি তা আমি জানি। কিন্তু ও আমাকে কিভাবে নিচ্ছে?

কোন ফাঁকে আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি। ঘুম থেকে উঠে নিশিকে পাশে পেলাম না। হতভম্বের মত বসে রইলাম। কেবিন থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক খুঁজলাম। কোথায় গেল মেয়েটা? ট্রেন এ পর্যন্ত তিনটা স্টেশনে থেমেছে। কোথাও নেমে যায়নি তো? নামবেই বা কেন? কিছুর প্রয়োজন হলে তো আমাকেই বলতে পারত। ওর ফোনটাও আমার পকেটে। যেন অকূল পাথারে পড়লাম আমি। কোনদিকে তীর তা জানি না। সাঁতরে কতক্ষণ টিকতে পারবও তাও বলা অসম্ভব। ডুবে মরা ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই। ট্রেনের প্রতিটি কামরা তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। বাড়িতে ফোন করলে কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে ভেবে বিরত থাকলাম। অনধিকার চর্চা করে পাশের কেবিনগুলোতেও খুঁজলাম। আমাদের মত এক নবদম্পতির আবেগঘন মুহুর্তে আঘাত দিতে খারাপ লাগছিল, কিন্তু নিজের ঘাট ফিরে পেতে বড্ড ব্যাকুল ছিলাম আমি। প্রায় দুঘন্টা কেটে গেছে। ট্রেনের প্রতিটি লোক ঘটনা সম্পর্কে এখন অবহিত। কয়েকজন বেফাঁস কিছু কথাও বলে ফেলেছিল। চিৎকার করে কান্না করাটাই বাকি রেখেছিলাম আমি। এ কোন পরীক্ষার মুখোমুখি হলাম আমি?

অবশেষে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলাম কেবিনে। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখছি, সবকিছু পেছনে ফেলে দুর্বার গতিতে ছুটে চলছে ট্রেন। আমার চোখে শেষ কবে অশ্রু ছিল মনে করতে পারছি না। বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। হাফ কেবিনে ভার্টিকালী দুটো সিট থাকে। ওপরের সিট থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, "আমরা কি চলে এসেছি?"
নিজেকে নিজে গাল দিলাম। চোখের পানি দ্রুত মুছে ফেললাম। ঘুমকাতুরে মেয়েটি যে আমাকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে ওপরের সিটে উঠবে এটা আমার মাথাতেই আসেনি।

অতপরঃ আমাদের গল্প বাড়তে থাকল। আমরা বেশ সুখিই ছিলাম। ঝগড়া করেছি হয়ত হাতেগোনা কয়েকবার। আলমগীর হতে না পারলেও একজন স্বার্থক বৌ-পাগল স্বামী হতে পেরেছি। কম কি?