সোমবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০১৪

হঠাৎ একদিন. . .

অনেক দিন পর ট্রেন এ উঠলাম। সেই কবে বাড়িতে গিয়েছিলাম, তার পর প্রায় ৫ বছর বাড়ি যাওয়া হয়নি। আত্মীয়স্বজন থাকলেও কাজের চাপে বাড়ি যাওয়ার কথা মাথায়ই আসত না। কিন্তু আজ না গেলে খবর আছে। খালাতো বোন অর্নেষার বিয়ে। সকাল সকাল ট্রেনে চাপার পরপরই একটা গ্রাম্য গ্রাম্য ঘ্রাণ পাচ্ছি।

ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস আসলেই ফার্স্ট ক্লাস। জানালার পাশেই সিট। বাচ্চা ছেলেপেলেদের মত আনন্দ পেলাম। আহা! অপরূপ বাংলা দেখতে দেখতে যেতে পারব। কিন্তু আগে যদি জানতাম জানালার পাশে বসার মজাটা হাত ছাড়া হয়ে যাবে তাহলে ট্রেনেই যেতাম না। কিন্তু কি আর করার? ফরচুন ডাজন্ট ফেভার দা পুরুষ।

কোথা থেকে এক মহীয়সী এসে জানালার পাশের সিটটা দলিলপত্র অর্থাৎ টিকেটসহ আবদার করছেন। একটা সময় ছিল পারলে কোনো লেডিস টেনে এনে পাশের সিটে বসাই, কিন্তু এখন কেমন যেন বিরক্তি লাগছে। সেই বয়স কি আর আছে? একটু পরপরই আড়চোখে তাকাচ্ছে মেয়েটা। অজ্ঞানপার্টির কেউ না তো! অবশ্য অজ্ঞান পার্টির কেউ হলে এভাবে জানালার পাশের সিট দাবী করত না। বরং তেল মারত। ধুর! অচেনা কাওকে নিয়ে এভাবে চিন্তা করাটা ঠিক না। বি পজেটিভ ম্যান!

মেয়েটার চোখে খুব যত্ন করে কাজল দেয়া। এতটা যত্ন করে কাজল দিতে এর আগে একজনকেই দেখেছি। কি ভেবে হাতের দিকে তাকাতেই প্রথম ঝটকা খেলাম। দশ বছরের পুরোনো একটা আংটি। খানিকটা বিপজ্জনকভাবে ঝুঁকে পায়ের দিকেও তাকালাম। মেয়েটার পায়ের দিকে তাকালাম। না না! এটা অসম্ভব!! ও কি আসলেই সাদিয়া। হ্যাঁ সাদিয়াই তো। এরকম ফর্সা পায়ের রং আর অই আংটি সাদিয়া ছাড়া আর কারো হতে পারেনা। রাফিন সবসময় বলত যে সাদিয়া একমাত্র পায়ের রং এর দিক দিয়ে ইউনিক। লজ্জা শরম আর ইগোর মাথা খেয়েই জিজ্ঞেস করলাম,

  সাদিয়া???
  চিনতে পেরেছ তাহলে। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি চিনবে না। না চিনলে আমিও পরিচয় দিতাম না।
  তোমাকে তো ভুলে যাইনি যে আলাদা ভাবে চিনতে হবে।

এতদিন পর এভাবে দেখা হওয়াটা আমার কাছে যথেষ্ট আশ্চর্যের খোরাক। এখনও অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে যতবার পাশের সিটে তাকাই ততবারই দশ বছর আগের একটা উঠতি বয়সের আবেগ নাড়া দিয়ে ওঠে। ও আগের মতই চুপচাপ! আমি আগের মতই বাচাল। শুধু সময়টা পাল্টে গেছে। মেয়েটার হাসি আগের মতই আছে। এটাও পাল্টায়নি একটুও। ওর মিষ্টি মুখমন্ডলের মায়াটাও একই আছে। বাচ্চা কাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করতেই এড়িয়ে গেল। আমি ভাবছিলাম একই প্রশ্নের সম্মুখীন আমাকেও হতে পারে। হলও তাই। উছিত হয়নি, তাও মোবাইল ঘেঁটে অর্নেষার একটা ছবি দেখালাম। কিন্তু তুমি কি বিশ্বাস করবে সাদিয়া, তোমার পর আর কাওকে স্বপ্ন দেখাইনি।

বেশ খানিকটা আলাপচারিতার পর একটা নিরবতা কাজ করছে আমাদের মধ্যে। কতদিন পর দেখা হলো মেয়েটার সাথে। কেমন যেন জীবনের ভারে নুয়ে পড়েছে। একটু আনন্দের খোঁজ একটু সুখের চাহিদা ওর চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। আমি তা স্পষ্ট দেখতে পারছি। আমার চোখে ওর কোনোকিছুই আড়াল থাকে না। হয়ত বিবাহিত জীবনের সুখ একরকম অধরাই রয়ে গেছে ওর কাছে।

  তোমার মনে পরে ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখ???
  হুমম। ওটা ভুলে যাওয়ার মত না। আমি ভেবেছিলাম তুমি ভুলে গেছ।
  তুমি কি করে বুঝলে ভুলে গেছি?
  একটা পুরনো স্মৃতি ভুলে যাওয়ার জন্য ১০ বছর যথেষ্ট সময়।
  ৯/১২/১২ তারিখ টা মনে আছে?
  হুমম। সেটাও মনে আছে। জীবনের শেষ স্বপ্নের মৃত্যুবার্ষিকীটা এই ছোট্ট স্মৃতিতে একরকম খোদাই করে আঁকা। কি করে ভুলি বল?
  আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম তোমার কাছে ফিরে আসতে। একটিবার ক্ষমা চাওয়া খুব দরকার ছিল তখন। কিন্তু পারিনি। নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এতটাই ক্লান্ত হয়ে পরেছিলাম যে একবার তোমার সামনে আসার সুযোগ করতে পারিনি। ভয় পেতাম। যদি তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও।
  যদি ফিরিয়ে না দিতাম. . . .
  অদিত, এত বড়স্বপ্ন দেখতে তখন ভয় পেতাম। অজানা আশংকা কাজ করতো।

সাদিয়ার গলা ধরে এসেছে। ওর চোখের জল আমার কাছে অসম্ভব যন্ত্রনাদায়ক। একটা সিগারেট খুব দরকার। কিন্তু ওর শেষ ইচ্ছা ছিল আমি যাতে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেই। আমি পারিনি সাদিয়া। তবে আজ খাব না। তোমাকে আর কষ্ট দিতে চাইনা।

  একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
  কি?
  তুমি কি আসলে সুখী হতে পেরেছ?

এবার সাদিয়া হুহু করে করে কেঁদে উঠলো। ওর প্রতি আমার টান টা যে কতোখানি গভীর তা এতক্ষণে বুঝলাম। আমার কি করা উচিত বুঝতে পারছি না। কাঁদুক। কান্না টা ওর খুব জরুরি। ওকে হয়ত সান্তনা ছাড়া দেওয়ার মত আর কিছু নেই। আমি আবারো নিরব।

দেখতে দেখতে কিভাবে সময় কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। সাদিয়া এখন অনেকটাই শান্ত। সময় ফুরিয়ে এসেছে। এখানেই আমাকে নেমে যেতে হবে। এর বেশিক্ষণ থাকার অধিকার আমার নেই।

ট্রেন থেকে নেমে একটিবারও পিছনে ফিরে তাকালাম না। তাকালে হয়ত সাদিয়ার জীবনযুদ্ধে পরাজিত মুখটাই দেখতে হত। কিন্তু আমি আমার সাদিয়া কে সবসময় হাসিখুশি দেখতে চেয়েছিলাম। বাস্তবে সব চাওয়া পূরণ হয়না। আমাদের দুজনের চাওয়া একই ছিল। কিন্তু তা পূরণ হয়নি। ভালো থেকো সাদিয়া। আমি তোমার বিষন্ন মুখটা আর দেখতে চাইনা। তোমার জন্য শুভকামনা রইলো। যদি কখনো ফিরে আসতে চাও আমার দরজা তোমার জন্য সবসময় খোলা থাকবে। সব বন্ধন যদি ছিন্ন করে ফিরে আসতে পারো তবে ফিরে এসো। আমার বিয়ে করার মিথ্যে টা না বললেও পারতাম। কিন্তু সবসময় সব সত্যি বলতে হয়না। আপাতত নাহয় তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় রইলাম।

রবিবার, ১২ জানুয়ারি, ২০১৪

-বিদায়-


আজমল আহমেদ খান একেবারেই সাধারণ সাদামাটা একজন ব্যক্তি। কাজপাগল এই ব্যক্তি সকাল সাড়ে সাতটায় ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে সাড়ে আটটা নাগাদ অফিসের জন্য বের হয়ে যান। ফেরেন রাত আটটায়। শুক্রবার এবং শনিবারের সারাদিন ঘরেই শুয়ে বসে সময় কাটান। তবে আজকের শুক্রবারে তার সেই অবকাশ নেই। আজ অনেক কাজ করতে হচ্ছে তাকে! একমাত্র মেয়ে শীলার বিয়ে বলে কথা! সেই আট বছর বয়স হতে আজমল সাহেবই এই শীলাকে কখনো বাবার আদর আবার কখনো মায়ের শাসনে বড় করেছেন। তার এই কষ্ট বৃথা যায়নি। শীলা বিবিএ সম্পন্ন করেছে বেশ সফলভাবেই। বাবার সব কথার বাধ্য এবং লক্ষী মেয়ে। আজমল সাহেব তো রীতিমত গর্ববোধ করেন এই মেয়েকে নিয়ে। মাঝে মাঝে অবশ্য মেয়ের অতিরিক্ত নজরদারীতে বিরক্তও হয়ে যান। ভালোবাসার অত্যাচার যে কতটা কড়া তা আজমল সাহেব হাড়ে হাড়ে জানেন। তবে আজ তার বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করছে। কেমন যেন একটা শুন্যতা তৈরি হচ্ছে, যেমনটি হয়েছিল প্রায় সতের বছর আগে। শীলার বয়স তখন সবে আট।

আজমল সাহেব মেয়ের বিয়ে নিয়ে যতটা না উত্তেজিত তার চেয়ে বেশি বিস্মিত! মেয়ের দিকে তাকিয়ে প্রায়ই কি যেন বিড়বিড় করতে থাকেন। মেয়েটা দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল! এই তো সেদিন কোলে করে স্কুলে না নিয়ে গেলে গাল ফুলিয়ে বসে থাকত মেয়েটা। ছুটির পর আইসক্রিম তার চাই ই চাই। সেই আইসক্রিম খেয়ে ঠান্ডা বাঁধিয়ে বসলে, স্কুলে না যাবার আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠত এই শীলা। অথচ আজ এই মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে। বহু দূর থেকেও একজন হয়ত এই মেয়েটিকে দোয়া করে যাচ্ছেন।

আজমল সাহেব প্রায়ই নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করেন। কারণ ভাগ্য কখনোই তাকে সহায়তা করেনি। এই মেয়েটার ভাগ্য তার চেয়েও খারাপ। মায়ের ভালোবাসা বেশিদিন জোটেনি। তবে আজ শীলা যে বাড়িতে যাচ্ছে, সেখানে মা, বোন, ভাই সবাইকেই পাবে। একজন বাবাও পাবে। কিন্তু এ বাড়িতে একজন বাবা তার মেয়েকে বিদায় জানাবে। এত আনন্দের মাঝে আজমল সাহেবের দুঃখ এই একটাই!


-হ্যালো!
-জ্বী ভাইসাহেব! বলুন।
কতদূর এলেন আপনারা?
-এইতো এয়ারপোর্ট ক্রস করছি। আর দশ পনের মিনিটের মত লাগবে।
-ভাই, আপনারা আসছেন তো?
-ছি ছি ভাইসাহেব! এটা কেমন কথা বললেন? আপনি প্রেশারের রোগী, খামোখা কেন চিন্তা করছেন? আমরা আসছি। আপনি এত দুশ্চিন্তা না করে একটু আরাম করুন, একটা পান চিবুতে থাকুন। আমরা এই এসে পড়েছি।
-আচ্ছা ঠিক আছে। আসুন তাহলে। আমি অপেক্ষা করছি।
-জ্বী আচ্ছা!

ফোনটা কেটে দিয়ে আজমল সাহেব একটু নিশ্চিন্ত হলেন। মেয়ের বাবা হলে যে দুশ্চিন্তা হয় তা ছেলের বাবা কিভাবে বুঝবেন?
শীলা আজ অনেক সুন্দর করে সেজেছে। মেয়েটার ছোটবেলা থেকেই সাজগোজ করার শখ। লাল বেনারশীতে পরীর মত লাগছে মেয়েটাকে। আজমল সাহেবের স্মৃতির পটে আরেকটি মুখ ভেসে ওঠে। আজ থেকে প্রায় সাতাশ বছর আগে এমনই একটি ফুটফুটে পরীকে ঘরে তুলেছিলেন বাকিটা জীবন একসাথে কাটানোর শপথ করে। মেয়েটা বড্ড জেদী ছিল। কি এক অভিমানে মেয়েটা পাড়ি দিল সাত আসমান। মাটির জানিস পুনরায় মাটিতে একাকার হয়ে গেল। আজমল সাহেবের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। হ্যাঁ, এটা অশ্রু। বিশ্বাসঘাতক অশ্রু!

আজমল সাহেবের বন্ধু বান্ধব সবাই এসে পড়েছেন। যে যার মত খেয়ে দেয়ে মেয়ে দেখছেন। যেন যাদুঘরে সাজানো কোনো মমি দেখছে। আজমল সাহেবের খানিকটা বিরক্ত লাগছে, আরে আজব! এত ছবি তোলার কি আছে? মেয়েটাকে শান্তিতে একটু বসে থাকতে দে। ফটোগ্রাফারটাকে মোটেও ভালো ঠেকছে না। হঠাৎই আজমল সাহবের কানে একটা কথা নাড়া দিল। "ছেলের বাবার নাকি বৌ দুইটা?"
মারাত্মক ক্ষেপে গেলেন আজমল সাহেব। লোকটার কথাটা আজমল সাহেব সহ একই সাথে অনেকের কানে গেছে। কথাটার উৎস বের করতে গিয়ে দেখলেন, পাশে এক লোক পান চিবুতে চিবুতে বলছে, "পাত্র নাকি প্রথম ঘরের বড় ছেলে।" এবার আর আজমল সাহেব সহ্য করতে পারলেন না। পানখোর সেই লোককে কিছু বলতে যাবেন, এমন সময় পাশের আরেক লোক দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে ফিক করে হেসে দিলেন। সাথে সাথে সবাই কেমন যেন চাপা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আজমল সাহেবকে জড়িয়ে ধরে পানখোর সেই লোকটা বলল, "আরে ভাই এত টেনশন নিতেছেন ক্যান? একটু রিল্যাক্স হন। ছেলের বাপের বৌ একটাই। আমরাতো একটু মজা করলাম।"
আজমল সাহেব সরে এলেন। এরা পেয়েছেটা কি? আরেকটু হলেই তো বুকের ব্যাথাটা বেড়ে উঠতো!

"বর আসছে, বর আসছে. . ."
আজমল সাহেব ছুটে গেলেন গেটে। বরকে বরণ করতে হবে। ফুলে সাজানো গাড়ি থেকে শেরওয়ানী পড়া এক রাজপুত্র বের হল। সাথে তার ছোট বোন। শ্বশুড়কে দেখেই পা ছুঁয়ে সালাম করতে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। সালামপর্ব শেষে আজমল সাহেব ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিলেন, হাতে গুজে দিলেন তিন ভরি স্বর্ণের একটি চেইন। সবাই অবশ্য বলেছিল আজমল সাহেব যেন চেইনটা ছেলেটাকে পরিয়ে দেন। কিন্তু এত মানুষের ভীড়ে কাজটা করলেন না। আর রাজপুত্রের মত এই ছেলেটাকে জামাই নয়, ছেলে ভাবতেই তার বেশি স্বাচ্ছন্দ।

শীলাকে বেশ হাসিখুশি লাগছে। ছেলেটাকে তার পছন্দই হয়েছে হয়ত। হবে নাই বা কেন? পছন্দটা কার সেটাও তো দেখতে হবে। আজমল সাহেব বহু ভেবে চিন্তে, দেখে শুনে সম্বন্ধ পাকা করেছেন। ছেলে ভালো চাকরীও করে। মোটা অংকের বেতন পায়। শীলা যে কখনো অভাবে থাকবে না তা একেবারে অনুমান করেই বলে দেয়া যায়। এদিকে খাবার টেবিলগুলো লোকে লোকারণ্য। প্রায় সাতশ লোকের আয়োজন করা হয়েছে। আজমল সাহেব জীবনের সব সঞ্চয় ঢেলে দিয়েছেন তার একমাত্র মেয়ের বিয়ের জন্য। ধুমধাম করে একমাত্র কন্যাকে সুপাত্রস্থ করাটা তো তার কর্তব্যই ছিল।

কাজী সাহেব বিসমিল্লাহ বলে দোয়া দুরুদ শুরু করলেন। আজমল সাহেব মেয়ের পাশেই বসা। একটি হৃদস্পন্দন টের পাচ্ছেন তিনি। বেশ সজোরে চলছে। কোনো কথা কানে যাচ্ছে না তার। মেয়ের "কবুল আলহামদুলিল্লাহ" কথাটা শোনার পর ঘোর কাটল তার। এবার ছেলের পালা। ছেলের পাশে গিয়ে বসলেন আজমল সাহেব। হাতটা ধরে কাজী সাহেবের কথা শুনছেন। আবারো একটি হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনতে পেলেন। ছেলের কবুল বলার সাথে সাথে সম্পন্ন হয়ে গেল বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। তবে এবার আর ঘোর কাটছে না তার।

অতিথিগণ সব একে একে বিদায় নিচ্ছেন। ফটোগ্রাফার ছোড়াটা এবার আরো দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে ছবি তুলছে। সময় খুব দ্রুত ঘনিয়ে এল। বাজছে বিদায়ঘন্টা। এবার তো আর আটকে রাখা যাবে না। ছেলের বাবা দ্রুত শেষ করতে চাইলেন। আজমল সাহেব মঞ্চে উঠে এলেন। মেয়ের হাতটি ছেলের হাতে তুলে দিলেন।
"বাবা, আজ থেকে এই মেয়ের সব দায়িত্ব তোমার। আমার আর কোনো অধিকার থাকলো না। আট বছর বয়স থেকে ওকে আমি যে আদর স্নেহ দিয়ে বড় করেছি, তা মুখে বলে বোঝাতে পারবো না।" গলা ধরে এল আজমল সাহেবের। ঢোক গিলে আবার শুরু করলেন, "মা মরা এই মেয়েটার খেয়াল রেখ। মায়ের মতই ভীষণ অভিমানী। অভিমান করলে মানিয়ে নিও, ভূল করলে শাসন করো। তবুও মনে কষ্ট দিও না।" আবারও আটকে গেলেন আজমল সাহেব। শীলা বারবার বলেছিল যাবার সময় যেন বাবা চোখে পানি না থাকে। আজমল সাহেব বহু কষ্টে পানি আটকে রেখেছেন। কিন্তু শীলা মেয়ে মানুষ, কান্না আটকাতে পারলো না। ঠিক ছোট্ট বেলার মত বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ এবং দীর্ঘশ্বাসের শব্দে একাকার পুরো হলরুম। আজমল সাহেব ঠোঁট কামড়ে রেখেছেন। আজ তিনি কাঁদবেন না।

ফুলে সাজানো গাড়িটি চোখের আড়াল হতেই মাটিতে বসে পড়লেন আজমল সাহেব। আর পারলেন না। কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। বয়সটা খুব খারাপ। আবেগ ধরে রাখা যায় না। আরেকটি বিদায়ে তিনি বলহীন হয়ে পড়েছেন। ওঠার ক্ষমতা তার নেই। সেই ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চাটাকে খুব মনে পড়ছে আজমল সাহেবের। মা মারা যাবার পরও যে বাবার চোখ মুছে দিয়েছিল। আজ যেন সেই চোখের পানিগুলো বাঁধ ভেঙেছে। আজ যে মুছে দেবার মত কেউ নেই। অতি কাছের মানুষগুলো এভাবেই বিদায় নেয়। পড়ে থাকে অশ্রুভেজা কিছু টুকরো স্মৃতি।


উৎসর্গ - সকল বাবাদের।